সুজন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিলাইছড়ি প্রতিনিধিঃ
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে ৬০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কৃষকেরা চাষ করেছে বিভিন্ন জাতের শিম ও সবজি। উপজেলা থেকে ফারুয়া নৌ-পথে যাওয়ার সময় রাইংখ্যং খালের দুই-দ্বারে নিজ ও পতিত জমিতে শত শত একর জায়গায় চাষ করেছেন এইসব শিম। তবে চাষ করেছেন ধান এবং অন্যান্য সবজিও। সবুজ ফসলের বিপ্লব ঘটিয়েছে এখানকার কৃষকরা। সবচেয়ে বেশি চাষ করছেন শীতকালীন শিম। প্রতিবছর চাষ করলেও এবছরে চাষ করেছেন আনাচে – কানাচে প্রায় সব জায়গাতেই। অনেকে বলছেন শিম চাষে ভাগ্য বদলে দিতে পারে এখানকার মানুষের ভাগ্য। খুঁটির মধ্যে বেঁধে দিয়ে সে-ই খুঁটি প্যাচিয়ে ঝোঁপঝাড় হয়ে সেই ঝোঁপে অনেক শিম ধরে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ৪ ইউনিয়নের মধ্যে বিলাইছড়ি ও ফারুয়া ইউনিয়নে বেশি লক্ষ্যণীয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ফারুয়া ইউনিয়নে। না দেখলে কোনো দিনও বুঝা যাবে না যে, এত শিম চাষ করা হয়েছে সেখানে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে হতে পারে বাম্পার ফলন। পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষকরা।
এদিকে বিলাইছড়ি ইউনিয়নে চাষ করা হয়েছে কুতুবদিয়া, বহলতলী, সাক্রাছড়ি, তিনকুনিয়া, মালুম্য এবং পাংখোয়া পাড়ার প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। আর ফারুয়া ইউনিয়নে চাষ করেছে চাইন্দা, উলুছড়ি, তক্তানালা, গো- ছড়া, চ-ছড়ি, ফু-ছড়া, রোয়াপাড়া ছড়া, আমকাটাছড়া, ওরাছড়ি, আবইমারা, যামুছড়া, লিত্তিছড়ি, গোয়াইনছড়ি, এগুজ্যাছড়ি, তারাছড়ি, যমুনা ছড়ি, শুক্কুরছড়ি উপরে এলাকা সহ প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকায়।
এব্যাপারে কুতুবদিয়া গ্রামের কৃষক দীলিপ তঞ্চঙ্গ্যা, মালুম্যা ও তিনকুনিয়া পাড়ার জয়ন্ত তঞ্চঙ্গ্যা ও ভুট্টু তঞ্চঙ্গ্যা, চাইন্দা পাড়ার টুম্পা তঞ্চঙ্গ্যা ও ভগমন তঞ্চঙ্গ্যা, উলুছড়ি পাড়ার বাল্টুরাম তঞ্চঙ্গ্যা ও উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, তক্তানালা পড়ার দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা ও ভুবন তঞ্চঙ্গ্যা, ওরাছড়ি পাড়ার বিলচান তঞ্চঙ্গ্যা, গোয়াইনছড়ি পাড়ার বাগান পুরি তঞ্চঙ্গ্যা’র সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, তাদের প্রত্যেকের প্রায় ২ থেকে ৪ একর জমি রয়েছে। যাদের নেই কমপক্ষে হলেও ১ খানি জমি রয়েছে। প্রায় সব জমিতে শিম চাষ করা হয়েছে। এখনো অবস্থা ভালো রয়েছে। ফুল আসার কাছাকাছি এবং অনেকের শিম বাগানে কিছু কিছু ফুল দেখা গেছে। যদি শিম গাছে রোগ-বালাই উৎপত্তি না হয় তাহলে গত বছরের তুলনায় এবছরের বেশি ফলন ঘরে তুলবে।
তারা আরও জানান, ডিলার বা বাজার থেকে বীজ ক্রয় না করে নিজ জমিতে উঠা সবচেয়ে ভালো বীজগুলো পরবর্তী বছরে জন্য সংগ্রহ করে রাখা হবে। কৃষি অফিস থেকেও তেমন সহযোগিতা নেন না। স্থানীয়দের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। রোগ-বালাই দমনের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে কৃষি অফিসের সহযোগিতা নিয়ে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। কৃষি অফিসাররা মাঝে মধ্যে আসেন বলেও জানান তারা।
এইসব বিষয়ে গোয়াইনছড়ির এলাকার হেডম্যান বিমল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, তার এলাকায় প্রায় ১০০ পরিবারের মতো শিম চাষ করেছে। তিনি নিজেও প্রায় দুই একরের মত জমিতে এই শিম চাষ করেছে। বর্তমানে কিছু কিছু ফুল আসা শুরু করেছে। প্রতি মন ৪০০০ থেকে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় হয়। পাশাপাশি এগুজ্যাছড়ি এলাকার সমূল্য হেডম্যান জানান, এই শিমের বীজগুলো অন্য ফসলের চেয়ে আগে তুলতে পারি এবং একটু বেশি দামে বিক্রি করি। যা সহজে পঁচে না বলে এখানকার লোকেরা বেশি এই চাষ করেছেন। তাছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থা একটু উন্নতি হওয়ায় সহজে শহর থেকে ব্যবসায়ীরা নিজ এলাকায় এসে দর-দাম করে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আগে তামাক চাষ করলেও উপজেলা কৃষি অফিস ও এনজিও’র পরামর্শ ও সহযোগিতায় বেশ কয়েক বছর ধরে এই শিম ও সবজি চাষ করছি। এবং বেশ লাভবান হচ্ছি। এ বছর বন্যা হওয়ায় ইদুঁরের উপদ্রব কম।
৩নং ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, আজ থেকে ২০ বছর আগে এই জায়গাগুলো যেদিকে তাকাই না কেন দুকুল জুড়ে শুধু নল খাগড়া, আর নল খাগড়া। পরে তামাক কোম্পানিরা খাগড়া ধ্বংস করে তামাক চাষ করতো।এর পরে তামাক চাষকে নিঃশেষ ও নিরুৎসাহিত করা হলে তামাকের পরিবর্তে মানুষেরা কিছু কিছু এ-ই শিম ও অন্যান্য সবজি চাষ করতো। তিনি আরও জানান, পর্যায়ক্রমে এই শিমের বিচি বা বীজগুলো বেশ বাজারজাত ও বিক্রয়ে চাহিদা এবং পুষ্টিগুণ বেশি থাকায় দিনদিন চাষে আগ্রহ বেড়েছে। প্রতিবছর করলেও এবছরে ব্যাপকভাবে চাষ করেছে। তাছাড়া গত বছর ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এ-ই ফারুয়া ইউনিয়ন। বন্যা’র ফলে জমিগুলোতে পলি জমেছে। তাই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এসব চাষে মনোযোগ দিয়েছেন এখানকার কৃষকরা। এছাড়াও এই এলাকার সাধারণ মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস হচ্ছে শিম চাষ।আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ভাগ্য বদলে দিতে পারে এখানকার জনগণের আয়ের উৎস। খুব কম করে হলেও খানি প্রতি ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পেতে পারে। যাদের জায়গা বেশি তারা বেশ কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে।
উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি অফিসার বিভূতি ভুষন চাকমা এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন গুপ্ত জানান, উপজেলায় ২০২৩ সালে জুম সিজনে ধান, সবজি, ভুট্টা সহ চাষ করেছে ১৯৪৭ হেক্টর। বর্ষা সিজনে আমন ধান সবজিসহ চাষ করেছে ১৭২ হেক্টর। রবি মৌসুমে গীল শিম ৭৪, ফরাস শিম ৩০, চিনাবাদাম ৬৪, বরো ধান ২৭২, ভুট্টা ২৬ হেক্টরসহ সব মিলিয়ে চাষ করেছে ৬৯২ হেক্টর। আর ২০২৪ সালে জুম সিজনে আউশ ধান চাষ করেছে ১৬৩৪, সবজি ২১২, ভুট্টা ২৪ হেক্টর, মোট ১৮৭০ হেক্টর জমিতে। আমন/বর্ষা সিজনে আমন ধান ১৫২, সবজি ২২ হেক্টরসহ মোট ১৭৪ হেক্টরে। রবি (শীত/বরো) মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ধান ২৭৭, গীল শিম ৭৫, চিনাবাদাম ৬৫, সবজি ২২৬, ফরাস শিম ৩০, ভুট্টা ২৬, সবজি ২২৬ হেক্টর মোট ৯২৫ হেক্টর জমি। এছাড়াও কৃষকদের প্রায় ৩০০০ জনের বেশি সবজি ও ধানের বীজ, সার এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আলীমুজ্জামান খান জানান, মোট উপজেলায় ১২ জন উপ-সহকারী কৃষি অফিসার থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ৬ জন। তাম্মধ্যে ফারুয়া ইউনিয়নে ওমর ফয়জুল হাসান, রনেক্স চৌধুরী সুকান্ত কুমার দায়িত্বে রয়েছেন।অন্য ইউনিয়নে রুবেল বড়ুয়া, অনুময় চাকমা এবং বিভূতি ভুষন চাকমা।
কৃষিপ্রধান উপজেলা হিসেবে দুর্গম এলাকায় কম জনবল দিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা খুবই কঠিন। এর পরেও প্রতিনিয়ত মাঠে কৃষকদের পারামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য জনবল অবশ্যই প্রয়োজন।