বিশেষ প্রতিবেদকঃ
“স্মার্ট লিগ্যাল এইড, স্মার্ট দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা ও আপোষে বিরোধ মীমাংসা কার্যক্রম বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময় সভা ৫ মে ২০২৪ লিগ্যাল এইড কার্য্যলয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাঙামাটিতে লিগ্যাল এইডে প্রান্তিক জনগোষ্টী পাচ্ছেন দ্রুত সময়ে আইনগত সেবা। আপোষে প্রত্যাহার হচ্ছে দীর্ঘ দিনের চলমান আদালতের মামলা। জট কমছে আদালতের বিভিন্ন মামলার।
রাঙামাটি জেলা শহরের রাজদ্বীপ। ভৌগলিকভাবে পৌর এলাকায় হলেও চারদিকে হ্রদ বেষ্ঠিত হওয়ায় রাজদ্বীপে সরাসরি সড়ক পথে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র যাতায়াতের সুযোগ নৌ-পথ। রাজদ্বীপের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা গীতা চাকমার জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। স্থানীয় বিভাস চাকমার পিতার কাছ থেকে কেনা জমি নিয়েই এই বিরোধ ৪২ বছর ধরে। বিরোধের জেরে আদালতে দায়ের হলো মামলা। অবশেষে সেই বিচারাধীন মামলা আপসে নিষ্পতি হলো জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমেই।
শুধু নজিরন আর গীতা চাকমাই নয়; রাঙামাটির প্রান্তিক মানুষের আইনি সেবা পাওয়ার শেষ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, পাহাড়ের প্রথাগত হেডম্যান-কারবারিদের মাধ্যমে সালিশে কোনো প্রতিকার না পেয়ে শেষ পর্যন্ত লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে সমাধান পেয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত শত শত। পারিবারিক বিরোধ নিষ্পতি, জমি সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পতি, টাকা উদ্ধারসহ নানান ধরণের আইনি সেবা দিয়ে যাচ্ছে লিগ্যাল এইড। এতে করে স্থানীয়দের আস্থা বাড়ছে লিগ্যাল এইডের সেবায়; অন্যদিকে আদালতেও কমছে মামলার জট।
৭০ বছরে এসে বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া মোছাম্মত নজিরন নেছা রাঙামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীমুখ ইউনিয়নের বাসিন্দা। প্রায় ৩০ বছর ধরেই মাইনীমুখে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কলসি কাঁধে করে পানি সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। উপজেলার আটারকছড়া ইউনিয়নের ইয়ারিংছড়ি মৌজায় তার রেকর্ডভুক্ত চার একর জমিও রয়েছে। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজের নামে রেকর্ডীয় জমিটি বেহাত হয়ে যায়। পুরো চার একর জমি বেদখল হয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েন নজিরন নেছা। সামাজিকভাবে গ্রাম্য সালিশ বসিয়েও হারানো জমি উদ্ধার করতে পারেনি নজিরন। ইয়ারিংছড়ির বাসিন্দা চান মিয়া ও ইসমাইল হোসেন নামের দুই ব্যক্তি তার জমিটিতে বেদখলে রাখে প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরেই। উল্টো জমি বেদখলকারীরা জাল দলিলমূলে তাকে হয়রানি করে আসছেন। জমি দখলে থাকা চান মিয়া ও ইসমাইল হোসেনের ভূমি ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে এক সময়ে এসে বিবাদ বাধে। সেই বিবাধ মেটাতে রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল অফিসে আসেন চান মিয়া। কিন্তু জায়গার নথিপত্রে কারো রেকর্ডের প্রমাণ ছিল না। অবশেষে সেই নজিরন নেছাকে নোটিশ দেয় জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। জমির মালিকানা রেকর্ডভুক্ত থাকায় বিনা খরচে সেই জমি ফিরে পেলেন নজিরন। উপকারভোগী নজিরন নেছা জানান, স্বামী মারা যাওয়ায় আমার অসহায়ত্বের কারণে আমার সব জমি বেদখল হয়ে যায়। লিগ্যাল এইড অফিসের চেষ্টায় আমি বিনা খরচে জায়গা ফেরত পেয়েছি। সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা ও আপসে বিরোধ মীমাংসার কার্যক্রম গ্রহনের মাধ্যমে আমার মতো গরীব অসহায় মানুষ বিচার পাচ্ছে।’
রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে ১ হাজার ৫১৬টি বিকল্প বিরোধ নিষ্পতির (এডিআর) আবেদন জমা পড়ে। তারমধ্যে ৪৭২টি আবেদন সফলভাবে আপস মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পতি হয়েছে। নিষ্পতির হার ৩১ দশমিক ১৩ শতাংশ। আপসে বিরোধ নিষ্পতির মাধ্যমে ১ কোটি ৭০ লাখ ৬৯ হাজার ৩২৫ টাকা ক্ষতিপূরণ ও পাওনা বাবদ আদায় হয়েছে। এতে উপকারভোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২৮৮ জন। আদালতে চলমান মামলা প্রত্যাহার হয়েছে ২৬টি। আবার ১ হাজার ৫১৬টি এডিআর আবেদনে মধ্যে ১ হাজার ৩৫৯ জন সেবাপ্রার্থীকে আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আইনি পরামর্শ গ্রহীতার হার ৮৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ইতিমধ্যে আরো প্রায় শতাধিক মামলা আপোষ মীমাংসায় নিস্পত্তি হয়।
লংগদুর গাঁথাছড়া আদর্শগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিজাম উদ্দিন রিংকু জানান, ‘মামলা না করে জজের মধ্যস্থতায় গরিব মানুষের বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করায় রাঙামাটির অসহায়, গরিব মানুষেরা ন্যায় বিচার পাচ্ছেন। নজিরন নেছা নামের একজন দুস্থ ও প্রান্তিক মানুষ নিজ নামে রেকর্ডীয় জমি থেকেও তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিহীন। অবশেষে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে তিনি ভূমি ফিরে পেলেন। আমরা এর জন্য সরকার ও বিচার ব্যবস্থাকে ধন্যবাদ জানাই।’
মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি মোঃ কামাল হোসেন কমল বলেন, ‘কোনো দালাল ছাড়া বিচারপ্রার্থীরা সরাসরি বিচারকের কাছ থেকে সেবা পাচ্ছেন। এটা স্থানীয় জনগণের মধ্যে খুব ভালোভাবে সাড়া জাগিয়েছে। বিনা খরচে আইনি সেবা পাওয়ায় এই অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা বাড়ছে এবং মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।’
রাঙামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ বলেন, ‘জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে আপসে বিরোধ মীমাংসার কেন্দ্রে পরিণত করে আদালতে মামলাজট কমানোর সরকারি নীতিকে আমরা বাস্তবায়ন করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের "সেরা লিগ্যাল এইড অফিসার ২০২৩" হিসাবে সম্মানিত করায় সদাশয় কর্তৃপক্ষের নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় প্রান্তিক জনগণের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জিং কাজে আমার পাশে থাকা প্রত্যেক সহকর্মী, জনপ্রতিনিধি, সরকারি সংস্থা,গনমাধ্যম সহ সকল সহযোগীকে কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি। জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আমাদের এই প্রচেষ্টা, তৎপরতা অব্যাহত থাকবে-এই অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করছি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : নিউটন চাকমা
সিএইচটি বার্তা