বিশেষ প্রতিবেদক, রাঙামাটিঃ
জনমনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, পূর্নবাসন করা হয়েছে ফ্যাসিস সরকারের নেতাকর্মী ও সুবিধাভোগীকে, আছে উপদেষ্টার সহকর্মীও আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে উৎসব। অন্তবর্তীকালীন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পুর্নগঠন নিয়ে জনমনে হতাশা ও ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সরকার পরিবর্তনের তিনমাস পর অবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুর্নগঠন করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর ২০২৪ ইং) পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তাসলীমা বেগম স্বাক্ষরিত পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপনে এসব আদেশ জারি করা হয়।
রাঙ্গামাটিতে অবসরপ্রাপ্ত জেলা কৃষি কর্মকর্তা কাজল তালুকদারকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ পুর্নগঠন করা হয়। কাজল তালুকদার রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদারের বড় ভাই বলে জানা গেছে।
এদিকে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নাম ঘোষনার প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর থেকে বিএনপি, জামাতের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে খুশি হওয়ার কথা থাকলেও আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে এক প্রকার উৎসবের বন্যা বইছে বলে খবর পাওয়া গেছে। পুর্নগঠিত রাঙ্গামাটি অর্ন্তবর্তীকালীন পার্বত্য জেলা পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন দেব প্রসাদ দেওয়ান (বাঘাইছড়ি), প্রনতি রঞ্জন খীসা (নানিয়ারচর), প্রতুল দেওয়ান (সদর), বরুণ বিকাশ দেওয়ান (সদর), ক্যসিংমং (কাপ্তাই), নাইউ প্রু মারমা (সদর), ড্যানিয়েল লাল মুয়ান পাংখোয়া (বিলাইছড়ি), রাঙাবী তঞ্চঙ্গ্যা (সদর), সাগরিকা রোয়াজা (সদর), দয়াল দাশ (নানিয়ারচর), মো. হাবীব আজম (সদর), মিনহাজ মুরশীদ (লংগদু), বৈশালী চাকমা (সদর) ও লুৎফুন্নেসা বেগম (সদর)।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ক্ষমতা বলে সরকার রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্ন্তবর্তীকালীন পরিষদ পুর্নগঠন করেছে। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিধান অনুযায়ী এ পরিষদ সব দায়িত্ব পালন করবে।
এদিকে রাঙ্গামাটিতে পুর্নগঠিত অর্ন্তবর্তীকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ে জনমনে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। উঠেছে বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। সম্প্রদায় ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলেও অনেকে জানান।
এ নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড়। ফেইসবুক ও গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বিগত সময়ে জেলার প্রত্যেক উপজেলা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে পরিষদ গঠন করা হলেও এবার জেলার গুরুত্বপূর্ণ বরকল, জুরাছড়ি, রাজস্থলী ও কাউখালী উপজেলার কাউকে নেওয়া হয়নি। আর নানিয়ারচর উপজেলা থেকে নেয়া হয়েছে ২ জন। বিপরীতে চেয়ারম্যানসহ ১৫ সদস্যের মধ্যে ৯ জনই রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার। তার মধ্যে ৫ জন নারী। এছাড়া পার্বত্য উপদেষ্টার ঘনিষ্ট আত্মীয় রয়েছেন বেশ কয়েকজন। যাদের মধ্যে নিয়োগ পেয়েছেন পার্বত্য উপদেষ্টার একান্ত সহকারী ও উপদেষ্টার সাথে বিগত সময়ে চাকুরী করা ইউএনডিপির সহকর্মী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহকর্মীর মা। পাশাপাশি জনগণের গ্রহণযোগ্য, বিশিষ্টজন ও বহুল পরিচিত হিসাবে যাদের নাম আলোচনা-প্রস্তাবনায় ছিল, পুর্নগঠিত পরিষদে তাদের কেউ নেই। বিপরীতে যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা কেউ আলোচনা-প্রস্তাবনায় ছিলেন না। কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগ সদস্য জনগণের কাছে অপরিচিত, অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত। গুরুত্বপূর্ন চার উপজেলা থেকে কোনো প্রতিনিধি না নিয়ে, সে সব উপজেলার শূন্য স্থান সদর থেকে পূরণ করে যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে তা জনগণের কাছে কখনো গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না।
নতুন অর্ন্তবর্তীকালীন পরিষদে মনোনীত রাঙাবী তঞ্চঙ্গ্যা হলেন ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সরকার মনোনীত সাবেক অর্ন্তবর্তীকালীন জেলা পরিষদের সদস্য ও রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ নেতার বড় ভাই লাল ছোয়াক পাংখোয়ার স্ত্রী। তিনি লাল ছোয়াক পাংখোয়াকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়ে বর্তমানে খ্রীস্টান ধর্ম পালন করেন। সে হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিরা রাঙাবীকে তঞ্চঙ্গ্যা বলে কখনো মনে করে না। এটা তারা মনে করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এভাবে রাঙাবীকে নিয়োগ দিয়েছে। তার মানে যা তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে অপমান করা ছাড়া কিছুই নয়।
তারা আরও বলেন, এতো তঞ্চঙ্গ্যা থাকতে কিভাবে রাঙাবী এই পদটি নিলো সে বিষয়েও হতাশ প্রায় তঞ্চঙ্গ্যা গোষ্ঠীরা। এজন্য তঞ্চঙ্গ্যারা মনে করে রাঙাবীকে দেওয়া মানে পাংখোয়াদের দেওয়া সমান। একইভাবে দেওয়া হয়েছে তারই ভাতিজা ড্যানিয়েল লাল মুয়ান সাং পাংখোয়া। এছাড়াও রাঙাবী তঞ্চঙ্গ্যা ও প্রতুল চন্দ্র দেওয়ান পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার সাবেক কর্মস্থলের (ইউএনডিপি) সহকর্মী। বৈশালী চাকমাও সুপ্রদীপ চাকমার নিকট আত্বীয় এবং প্রতিবেশী। সাগরিকা রোয়াজা এককালে জাতীয় পাটি করতেন পরে আওয়ামীলীগে যোগ দেন। তিনিও উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার সাবেক কর্মস্থলের (পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড) এর সহকর্মী ডজি ত্রিপুরার মা। বরুন বিকাশ দেওয়ান সাবেক ফুটবল খেলোয়ার। বিগত ফ্যাসিস সরকারের সাংসদ দীপংকর তালুকদারের একান্ত আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। ফ্যাসিস সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে দীর্ঘদিন যাবত রাঙ্গামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীপংকর তালুকদার তাকে জাতীয় পুরষ্কারের ও ব্যবস্থা করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ক্যসিংমং মারমা কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম মৌজার হেডম্যান। তিনি আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।
জানাগেছে, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের রাঙামাটির জেলার অধিকাংশ তৎকালীন ফ্যাসিস সরকারের দলীয় কিংবা একনিষ্ঠ কর্মী সমর্থক বলে স্থানীয়দের তথ্যমতে। তম্মধ্যে নারী সদস্য নাইউ প্রু মারমা রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের নেতা বাচ্চু মং মারমার স্ত্রী।
অন্যদিকে, লুৎফুন্নেসা বেগম হলো বিগত ফ্যাসিস সরকারের সাবেক বন ও পরিবেশ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের পারিবারিক এনজিও সুখী বাংলা ফাউন্ডেশনের পাটনার সংস্থা পর্বত মানব উন্নয়ন সংস্থা-পাড়ার নির্বাহী পরিচালক আব্বাস উদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী। বিগত সময়ে তার কথিত এনজিও পাড়ার মাধ্যমে জলবায়ু ফান্ডের কোটি কোটি টাকা আত্নসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় ব্যাপক ভাবে সংবাদ প্রচার হয়েছে।
আব্বাস উদ্দিন চৌধুরী রাঙ্গামাটি জেলা যুবলীগের সভাপতি ও রাঙ্গামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীর বোনের দেবর। সেই সুবাদে আব্বাস উদ্দিন চৌধুরী একবার দুদুক রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক ও হয়েছিল। নিজে সুযোগ না পেয়ে স্ত্রীকে পদ পাইয়ে দেয়।
সদস্য দয়াল দাশ নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। প্রায় সময় চট্টগ্রাম শহরে থাকেন। নানিয়ারচর উপজেলা থেকে অপর সদস্য প্রনতি রঞ্জন খীসা তিনি বুড়িঘাট ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ইউপিডিএফর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। তবে বর্তমানে এলাকায় নিয়মিত থাকেন না বলে জানা গেছে।
সদস্য দেব প্রসাদ দেওয়ান। তিনি বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং ডিগ্রি কলেজের অবসরে যাওয়া অধ্যক্ষ। আগামী ডিসেম্বর মাসে ওনার অবসরত্তোর ছুটি শেষ হওয়ার কথা। তিনি সকলের নিকট স্বজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে সদস্য মিনহাজ মুরশিদ লংগদু উপজেলার বাসিন্দা হলেও ঢাকায় একটি বেসরকারী প্রতিষ্টানে চাকুরী করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া কালীন সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক ইনানের রুমমেট ছিলেন এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ইনানের সাথে তার কর্মকান্ডের ছবি ফেইসবুকে সয়লাব আছে। জনশ্রুতি ছিলো ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকীয় পদের জন্য মনোনীত ছিল। কিন্ত ৫ আগষ্ট ফ্যাসিস সরকার পতনের পর সুযোগ বুঝে ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে মিছিল মিটিং এ অংশ গ্রহন করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠনের সদস্য পরিচয়ে জেলা পরিষদের সদস্য পদ ভাগিয়ে নেন।
অপরদিকে হাবিবে আজম পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাঙ্গালী ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি করলেও তিনি ফ্যাসিস সরকারের সাবেক সাংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের পৃষ্টপোষকতায় তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন বলে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
এ ধরনের বিতর্কিত লোক নিয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্ন্তবর্তীকালীন পুর্নগঠিত পরিষদকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া পোস্টে অনেকের মন্তব্য লক্ষ্য করা গেছে। প্রস্তাবিত প্রার্থীদের নাম না থাকায় অনেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদও জানিয়েছেন।
সুত্রে জানা গেছে, আগামী রবিবার থেকে বিভিন্ন পক্ষ থেকে এসব সদস্যদের বাতিলের দাবীতে গণ-আন্দোলনের জন্য সমাবেশে প্রস্তুতি চলছে। জনগুরুত্ব পূর্ন এসব প্রতিষ্ঠানে জনগুরুত্বহীন প্রতিনিধি নির্বাচন করায় পুরো জেলায় সাধারনের মধ্যে হতাশা ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রজ্ঞাপন হওয়ার পর এলাকায় প্রচার হয়েছে তিনি কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য অংশু সাইন চৌধুরীর তদবিরে সদস্য পদে মনোনীত হয়েছেন।