কাপ্তাইয়ে বন্যহাতি আক্রমণে ৬ মাসে ৩ জনের মৃত্যু, সোলার ফেন্সিং ও সতর্কতায় বন বিভাগের কড়া নজরদারি
রিপন মারমা, কাপ্তাই (রাঙ্গামাটি) প্রতিনিধিঃ
রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় বন্যহাতির আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। কখনো রাতে, আবার কখনো দুপুরে লোকালয়ে নেমে আসছে বন্য হাতির পাল। হাতির আতঙ্কে দিনরাত উদ্বেগে সময় কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যানবাহন চলাচলও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, গাড়ি চালকরাও রয়েছেন আতঙ্কে।শুধু সাধারণ মানুষ নয়, প্রশাসনের কর্মকর্তারাও হাতির আতঙ্কে রয়েছেন। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে কাপ্তাই-আসামবস্তী সড়কে বন্য হাতির উপস্থিতির কারণে মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, গত ৬ মাসে হাতির আক্রমণে অন্তত ৩ জন নিহত হয়েছেন ও আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন এবং ঘরবাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এই প্রাণহানি ঠেকাতে এবং পর্যটকসহ স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাপ্তাই বন বিভাগ ‘সোলার ফেন্সিং’ সচল করার পাশাপাশি সড়কে রং দিয়ে বিশেষ সতর্কতা সংকেত ও সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে।কাপ্তাই-আসামবস্তী সড়ক এবং কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন এলাকায় হাতির আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। গত নভেম্বর মাসে একই দিনে মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে দুই নারী হাতির আক্রমণে নিহত হন। এর আগে বছরের শুরুতে আরও একজন ব্যক্তি হাতির কবলে পড়ে প্রাণ হারান। মূলত সন্ধ্যার পর এবং ভোরে হাতির পাল লোকালয়ে ও প্রধান সড়কে চলে আসায় এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।সোলার ফেন্সিং ও আধুনিক সুরক্ষা হাতিকে লোকালয় থেকে দূরে রাখতে বন বিভাগ কাপ্তাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ৮ কিলোমিটার ব্যাপী সোলার ফেন্সিং (Solar Fencing) কার্যক্রম জোরদার করেছে।সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে এই ফেন্সিংয়ে মৃদু বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়, যা হাতিকে আঘাত না করে কেবল ভয় দেখিয়ে বনে ফিরিয়ে দেয়।যান্ত্রিক ত্রুটি সরিয়ে বর্তমানে ফেন্সিংটি পুরোদমে সচল রয়েছে, যা বন সংলগ্ন বসতিগুলোর জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আসামবস্তী-কাপ্তাই সড়কের রাইন্যাটুকুন এলাকা, প্রশান্তি পার্ক এলাকা, সীতা পাহাড়, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের প্রবেশমুখ, নৌবাহিনী সড়ক, কামিল্লাছড়ি-আসামবস্তি, রাইখালি, কারিগর পাড়া, খন্তাকাটা ও ব্যাঙছড়ি এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ে হাতির খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় বন্য হাতির পাল খাদ্যের সন্ধানে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেক সময় একেক জায়গা দিয়ে তারা চলাচল করছে।
কাপ্তাই একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা হওয়ায় সড়কে রং ও পর্যটকদের জন্য সতর্কতা বহিরাগত পর্যটকদের সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। যেসব স্থান দিয়ে নিয়মিত হাতি পারাপার হয় (এলিফ্যান্ট করিডোর), সেসব স্থানে উজ্জ্বল রঙের সংকেত ও সতর্কতা হাতি ও মানুষের সংঘর্ষ এড়াতে কাপ্তাই-আসামবস্তী ও নৌবাহিনীর প্রধান সড়কের পিচঢালা পথে দিয়ে বড় বড় অক্ষরে ‘সাবধান, হাতি চলাচলের পথ’ লিখে দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের উদ্দেশ্যে বন বিভাগ থেকে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। হাতি দেখলে হর্ন না বাজাতে, ছবি তুলতে বা ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করতে এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।বনের প্রবেশমুখ ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে নতুন করে বড় বড় সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।

কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মো: ওমর ফারুক স্বাধীন জানান, “আমরা মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সোলার ফেন্সিং নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে এবং সড়কে রং দিয়ে চিহ্নিত করার ফলে চালকরা এখন অনেক বেশি সচেতন। তবে পর্যটকদের বনের ভেতরে একা না যাওয়ার জন্য এবং নির্ধারিত নির্দেশনা মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
“পার্বত্য চট্টগ্রামের এই প্রাকৃতিক পরিবেশে হাতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বন বিভাগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


















